প্রিয় কর্নার

ঐতিহাসিক কাশিমবাজারের ৩শ বছরের ডাচ কবরস্থান

 

ওলন্দাজ উত্তমাশা অন্তরীপের পথ আবিষ্কার এবং ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে সরাসরি সামুদ্রিক বাণিজ্যের পথ উন্মুক্ত করে ষোল শতকে পর্তুগিজরা এশিয়া থেকে ইউরোপে ব্যাপকহারে ও সরাসরি মশলা-বাণিজ্যের নতুন ধারার সূচনা করে। ওলন্দাজ বা ডাচরা ‘ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ গঠন করে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ১৬০২ খ্রিস্টাব্দে এই উপমহাদেশে আসে। ভারতবর্ষে তারা কোম্পানির সনদ অনুযায়ী কালিকট, নাগাপট্টম বাংলার চুঁচুড়া ও বাঁকুড়ায় বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। এছাড়া কাশিমবাজার ও বরানগরেও তারা কুঠি স্থাপন করে।  কালকাপুরের কাশিমবাজার রেলস্টেশনের পাশেই ডাচ কবরস্থানটি অবস্থিত যেখানে ১৬৬৬  খ্রিস্টাব্দে ডাচদের বিশাল কারখানাগুলি ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজদের আগমনের অনেক আগেই পর্তুগিজ, ওলন্দাজ ও ফরাসিদের আগমন ঘটে। কিন্তু ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পর ইংরেজদের আধিপত্যই প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। ১৭৫৯ সালে ঘটে যাওয়া বিদারার যুদ্ধে ওলন্দাজরা শোচনীয়ভাবে ইংরেজদের কাছে পরাজিত হয়ে উপমহাদেশে কোণঠাসা হয়ে পড়ার পরও আরও প্রায় ৫০ বছর তারা এখানে বাণিজ্য করতে থাকে।

কাশিমবাজারের ডাচ কবরস্থান, ছবি উৎসঃ destimap.com

কিন্তু ১৮০৫ সালে ওলন্দাজরা ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যায়। এভাবে প্রথমে পর্তুগিজ ও পরে ওলন্দাজরা এদেশ থেকে চলে যায় আর ইংরেজরা পুরোপুরি আসন গেড়ে বসে। কাশিমবাজার রেলওয়ে স্টেশনের কাছে অবস্থিত কালকাপুরে ডাচ বণিকদের বসবাস ছিলো। তারা মূলত হীরা জহরতের ব্যবসা করতেন। ১৬৬৬ সালে কালকাপুরে প্রথম একটি ডাচ ফ্যাক্টরির কাজ শুরু হয়। তখন আনুমানিক সাতশো থেকে আটশো লোক এখানে নিয়মিত কাজ করতেন। ভারতবর্ষের প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের এক ফরাসি বন্ধু ছিলেন যার নাম ছিল জর্জ লুই ভার্নেট। তিনি ১৭৫৬ সালে এখানকার সর্বময় কর্তা হিসেবে আসেন। সেইসব ডাচ কারখানা অনেক আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে যার কিছুই আজ আর অবশিষ্ট নেই।

 

তখন এখানে যারা কর্মসূত্রে এসেছেন, থেকেছেন – তাদের অনেকেই এখানেই মৃত্যু বরণ করেছেন। যারা এখানেই মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের জন্য একটি পৃথক কবরস্থান তৈরি করা হয়েছে। যেহেতু তারা ভিন্ন ধর্মালম্বী তাই তাদের জন্য এমন পৃথক কবরস্থান বা সমাধিক্ষেত্র। মুর্শিদাবাদে যদিও এরকম আরও পৃথক পৃথক সমাধিক্ষেত্র রয়েছে, যা ভারতীয় উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের স্মৃতি ধারন করে আছে। এখানে ডাচদের সমাধির সাথে রয়েছে মুসলমান, সুবেহ বাংলার শাসক ও ইংরেজদের সমাধি। এইসব ছোট ছোট সমাধিক্ষেত্র ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে চলছে। প্রত্যেকটি সমাধিই ইতিহাসের একেকটি অধ্যায়ের স্বাক্ষী। প্রত্যেকটি সমাধিক্ষেত্রে কান পাতলে শোনা যাবে ইতিহাসের মহাকালের শব্দ গুঞ্জন, যা আমাদের নিয়ে যাবে শত শত বছর আগে।

  কাশিমবাজারের ডাচ কবরস্থান, ছবি উৎসঃ destimap.com

বর্তমানে ঐ কারাখানার আর কিছুই অবশিষ্ট নেই, তবু ডাচ সিমেট্রিটি এখনও দাড়িয়ে আছে ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে। এখানে সর্বমোট ৪৩ টি কবর রয়েছে এর চারপাশে এখন বসতবাড়ি ও বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। কবরগুলো কোন মতে মাটির উপরে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। যদিও কয়েকটি কবরের উপরে ফলক রয়েছে , কিন্তু তার লেখা আজ আর বোঝার উপায় নেই।এখানে যে সমাধি গুলো রয়েছে তা ১৭২১ থেকে ১৭৯২ সালের মধ্যে যারা মারা গিয়েছে তাদের। এই করব স্থানের সবচেয়ে পুরনো কবরটি হলো ড্যানিয়েল ভ্যান দার ম্যূল এর, যিনি ১৭২১ সালে মারা যান। কিন্তু কোনটি যে তার সমাধি তা আর এখন বোঝার উপায় নেই। কারণ, লেখা মুছে গেছে আরও অনেক আগেই। ‘সমাধি পরিচিতি’ থেকেই জানা যায় পুরনো কবরটির তথ্য। ব্রিটিশ সিমেট্রিতেও একই অবস্থা। মানুষের নখরাঘাতে সমাধির নাম-পরিচয়ও মুছে গেছে, যেমনি গেছে কলমের আঘাতে ইতিহাস।

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *